কিছুক্ষণের জন্য কল্পনা করুন, কোন এক রাতে এলোমেলো স্বপ্ন থেকে হঠাৎ জেগে উঠলেন। পরিপার্শ্বের ঘোর অন্ধকারের সাথে তাল মিলাতে চোখ কচলে নিলেন, তারপর বোধদয় হল। আর নিজেকে আবিষ্কার করলেন ঘন কালো অন্ধকারে আবৃত বিস্তীর্ণ এক গুহার মধ্যে। বিস্মিত হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন: আমি কোথায়? এই স্থানটি কি? এর মাত্রাগুলোই বা কেমন?
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সেখানে স্তুপ করে রাখা অনেকগুলো ম্যাচের বাক্স খুঁজে পেলেন। একটি ম্যাচ ধরালেন, কিন্তু জ্বলে উঠার সাথে সাথেই তা মিইয়ে গেল। প্রতিটি কাঠিই ধরানোর অল্প সময়ের মধ্যে নিভে যেতে লাগলো। কিন্তু, তখনই বুঝতে পারলেন, কাঠিটি যে অল্প সময় জ্বলে থাকে ততক্ষণে পরিপার্শ্বের কিছুটা আপনি দেখে নিতে পারেন। পরের ম্যাচটি জ্বেলে উল্টোদিকে একটি দেয়াল দেখতে পেলেন। আরেকটি ম্যাচ জ্বেলে দেখতে পেলেন অদ্ভুত ছায়া যা সেখানে বৃহদাকার কোন বস্তুর উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। পরের ম্যাচ জ্বেলে বুঝতে পারলেন আপনি স্থির নন, হয় আপনি চলমান আছেন নয়তো আপনার সাপেক্ষে কক্ষটি চলমান। এভাবে প্রতিটি ক্ষণস্থায়ী অগ্নিশিখায় একটু একটু করে আপনার জানার পরিধি বাড়তে লাগলো।
স্থূল অর্থে, এই পরিস্থিতি পৃথিবীতে আমাদের ধাঁধাময় অবস্থাকেই নির্দেশ করে। বহু শতাব্দী ধরে যা করছিলাম, এখনও আমরা তা করে যাচ্ছি, আমাদের গ্রহীয় প্লাটফর্মে দাড়িয়ে রাতের আকাশে সজাগ দৃষ্টি মেলে বুঝতে চেষ্টা করছি, গুহাসম এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান কোথায়। ক্ষণকালের স্ফূলিঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, মহাকাশে সুবৃহৎ কিছু পদার্থ রয়েছে। এবং এই পদার্থগুলোর গতি ও আপাত ছায়া বলে দিচ্ছে, আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে আরও অনেক বেশী কিছু।
মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্ত থেকে আসা প্রতিটি ফোটন থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহের জোড় প্রচেষ্টা চালাই। স্বর্গ থেকে যে আলো পৃথিবীতে আসে তার অধ্যয়নকেই বলা হয় জ্যোতির্বিজ্ঞান। ভূমিস্থিত ও মহাকাশে ঘূর্ণায়মান দুরবিন থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ আলো সংগ্রহই কেবল আমাদের কাজ নয়, বরং এই আলোর মাধ্যমে মহাবিশ্বে দৃশ্যমান পদার্থনিচয়ের তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে গুপ্ত পদার্থগুলো সম্বন্ধে ধারণা লাভই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। অদৃশ্য বলতে বুঝাচ্ছি, যা দৃশ্যমান নয় কিন্তু আমাদের জানা তথ্যমতে তার উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী।
মহাবিশ্বের প্রসারণ ও ছায়াপথ সংশ্লিষ্ট ৫০ বছরের উপাত্ত একসাথে নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মহাবিশ্বের শতকরা অন্তত ৯০ ভাগ পদার্থ বা কণাই আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। অন্য কথায়, মহাবিশ্বের অধিকাংশ পদার্থই বিকিরণ করে না- তড়িচ্চুম্বকীয় বর্ণালিতে ধারণক্ষম কোন কিরণও তারা প্রদান করে না। প্রায় ৬০ বছর পূর্বে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিৎস ৎসুইকি সর্বপ্রথম এ ধরণের পদার্থর কথা বলেছিলেন। এরা ছায়াপথ স্তবকের কেন্দ্রে অবস্থিত বলে তিনি অনুমান করেছিলেন। এগুলোকে তিনি তথাকথিত নিরুদ্দিষ্ট পদার্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই নিরুদ্দিষ্ট ভরকে এখন আমরা “গুপ্ত পদার্থ” (Dark Matter) বলি, কারণ ভর নয় বরং আলোই এখানে নিরুদ্দিষ্ট।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পদার্থবিদরা এই গুপ্ত পদার্থের অনেক ধরণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একপক্ষ বলেন, এরা সাধারণ পদার্থের মতোই; যেমন- অতি ক্ষীণ তারা, ছোট বা বড় কৃষ্ণ বিবর, শীতল গ্যাস বা মহাবিশ্বে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা ধূলিরাশি, যারা এতো ক্ষীণ বিকিরণ নিঃসরণ বা প্রতিফলন করে যে আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়েনা। এমনকি এরা একটি নির্দিষ্ট ধরণের গুপ্ত পদার্থও হতে পারে যাদেরকে “ম্যাচো” (MACHO – MAssive Compact Halo Objects) বলা হয়। ছায়াপথ বা ছায়াপথ স্তবক ঘিরে থাকা বর্ণবলয়ে এই ম্যাচোগুলো অদৃশ্যভাবে ওত পেতে থাকে। অন্য বিজ্ঞানীরা বলেন, গুপ্ত পদার্থ এমন ধরণের বহিরাগত বা অপরিচিত পদার্থ ও কণা যা পর্যবেক্ষণ করার মত প্রযুক্তি আমরা এখনও উদ্ভাবন করতে পারিনি। পদার্থবিজ্ঞানীরা এ সম্বন্ধে অনেক তত্ত্বকথা বললেও পরীক্ষণের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়নি। তৃতীয় আরেকটি সম্ভাবনা হল, অভিকর্ষ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অনেকটাই ভুল পথে এগোচ্ছে এবং এর বড় রকমের পরিবর্তন আবশ্যক। অবশ্য অধিকাংশ পদার্থবিজ্ঞানীই এ ধরণের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছেন।
একদিক থেকে চিন্তা করলে, গুপ্ত পদার্থর ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা বিশ্বতত্ত্বের অন্যান্য অসাধারণ কিছু বিষয়ের সাথে জট পাকিয়ে গেছে যা ছাড়ানোও কষ্টসাধ্য। যেমন- মহাবিশ্ব কতোটা ভর ধারণ করে, ছায়াপথগুলো কিভাবে গঠিত হয়েছিল এবং মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে প্রসারিত হতে থাকবে কি-না। মহাবিশ্বের আকার, আকৃতি ও চূড়ান্ত পরিণতি বোঝার জন্য গুপ্ত পদার্থ এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, আগামী কয়েক দশক ধরে এটিই জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণার মুখ্য বিষয় হয়ে থাকবে।
অদৃশ্যকে পর্যবেক্ষণ
যা দেখা যায়না তা বুঝতে পারা বেশ কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আজকাল পর্যবেক্ষণযোগ্য পদার্থর উপর গুপ্ত পদার্থর প্রভাব নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে গুপ্ত পদার্থ অধ্যয়ন চালিয়ে যাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, নিকটবর্তী একটি তারাকে যখন সুনির্দিষ্ট তাত্ত্বিক কারণে কম্পিত হতে দেখি, তখন হিসাব কষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, একটি “গুপ্ত গ্রহ” তাকে প্রদক্ষিণ করছে। কুণ্ডলাকার ছায়াপথের ক্ষেত্রে আমরা একই পদ্ধতিতে গুপ্ত পদার্থের উপস্থিতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। কারণ এই গুপ্ত পদার্থের কারণেই ছায়াপথের তারাগুলো অমোচনীয় গতিতে নিজ নিজ পথে গতিশীল থাকে।
কুণ্ডলাকার ছায়াপথকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান তারা ও গ্যাসীয় মেঘের কক্ষপথ পর্যবেক্ষণ করে আমরা দেখতে পাই, তাদের গতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশী। এই অপ্রত্যাশিত উচ্চ বেগই বুঝিয়ে দেয়, ছায়াপথের দৃশ্যমান পদার্থগুলোর চেয়ে অনেক বেশী কিছু থেকে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় টান সেখানে উপস্থিত রয়েছে। গতির বিস্তারিত পরিমাপের মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্তে এসেছি, বিপুল পরিমাণ গুপ্ত পদার্থ কর্তৃক প্রয়োগকৃত মহাকর্ষ বলই তারা ও গ্যাসীয় মেঘগুলিকে উচ্চ গতির কক্ষপথে ধরে রাখছে। আমরা প্রতিপাদন করেছি যে, গুপ্ত পদার্থ ছায়াপথ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এই পদার্থর উপস্থিতি ছায়াপথের দৃশ্যমান প্রান্ত থেকে শুরু করে আলোকজ্জ্বল ছায়াপথীয় চাকতির উপর নিচ পুরোটা জুড়েই রয়েছে। স্থুল অনুমিতির সাহায্যে বলা যায়, আমাদের আকাশগঙ্গার মত আদর্শ কুণ্ডলাকার ছায়াপথ অপেক্ষাকৃত সমতল দেদীপ্যমান চাকতি হিসেবে গুপ্ত পদার্থর একটি গোলকীয় বর্ণবলয়ে দৃঢ়ভাবে গেঁথে আছে- অনেকটা অতি মাত্রায় বিক্ষিপ্ত মেঘের মত।
ছায়াপথের মধ্যস্থিত প্রত্যেকটি তারার ছায়াপথীয় কেন্দ্রকে ঘিরে এতো দ্রুত গতিতে আবর্তন করতে হলে, ছায়াপথের মহাকর্ষ সৃষ্টিকারী যে পরিমাণ ভর থাকা প্রয়োজন তার মাত্র দশ ভাগের এক ভাগের হদিস পাওয়া যায়। একটি নির্দিষ্ট ছায়াপথের দিকে লক্ষ্য করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এটি বুঝতে পেরেছেন। সেই ছায়াপথের প্রায় ৫০,০০০ আলোবর্ষের মত ব্যাসার্ধ্যের মধ্যে তাই বিপুল পরিমাণ পদার্থ আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে।
ছায়াপথের একটি স্তবকে গুপ্ত পদার্থের পরিমাণ ও বণ্টন আবিষ্কার করতে গিয়ে এক্স-রশ্মি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, স্তবকের মধ্যস্থিত ছায়াপথগুলো ১০০ মিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রার বিক্ষিপ্ত গ্যাসের মধ্যে নিমজ্জিত অবস্থায় ভাসতে থাকে। এই উচ্চ তাপমাত্রার গ্যাসের শক্তি অনেক বেশী হলেও তাদেরকে চিহ্নিত করা বেশ কষ্টকর। আলোকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যেমন একটি নির্দিষ্ট ছায়াপথের তারাসমূহের বেগ ব্যবহার করেন তেমনই এক্স-রশ্মি পর্যবেক্ষকরা এই রশ্মি নিঃসরণকারী গ্যাসের তাপমাত্রা এবং প্রাচুর্যকে ব্যবহার করতে শিখেছেন। উভয় ক্ষেত্রেই প্রাপ্ত উপাত্তসমূহ দৃষ্টির আড়ালে থাকা পদার্থর প্রকৃতি ও অবস্থান বিষয়ক তথ্য সরবরাহ করে।
ছায়াপথের একটি স্তবকে এক্স-রশ্মি নিঃসরণকারী অঞ্চলের পরিমাণ এবং গ্যাসের তাপমাত্রা পরিমাপ করার মাধ্যমে আমরা স্তবকের ব্যাসার্ধ্যের মধ্যে উপস্থিত মহাকর্ষক ভরের মোট পরিমাণ অনুমান করতে পারি। স্তবকের ব্যাসার্ধ্য প্রায় ১০০ মিলিয়ন আলোক বর্ষের মতো হয়ে থাকে। আদর্শ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে, স্তবকের মধ্যস্থিত দেদীপ্যমান পদার্থ এবং এক্স-রশ্মি নিঃসরণকারী উত্তপ্ত গ্যাসের মোট পরিমাণ একসাথে করলেও তা স্তবকের মোট মহাকর্ষক ভরের শতকরা মাত্র ২০ থেকে ৩০ ভাগ হয়। অবশিষ্টাংশ তথা গুপ্ত পদার্থ নামে পরিচিত অংশ তখনও বর্তমান যন্ত্রপাতির পক্ষে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়ে উঠেনা।
অদৃশ্য পদার্থ চিহ্নিত করার সূক্ষ্ণতর পদ্ধতি বর্তমানে উদ্ভাবিত হয়েছে। একটি মজার পদ্ধতি হচ্ছে ছায়াপথ স্তবকের চারদিকে বলয় বা আর্ক চিহ্নিত করা যাদেরকে “আইনস্টাইন বলয়” বলা হয়। মহাকর্ষীয় লেন্সিং নামক ক্রিয়ার কারণে এই বলয়ের সৃষ্টি হয়। একটি সুবৃহৎ পদার্থর মহাকর্ষ যখন এর কাছ দিয়ে যাওয়া আলোকে বাঁকিয়ে দেয় তখনই মহাকর্ষীয় লেন্সিং ক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ ধরি, একটি ছায়াপথ স্তবক আরও দূরের অন্য একটি ছায়াপথকে আমাদের থেকে আড়াল করে দিয়েছে। এখন স্তবকটির মহাকর্ষ দূরের ছায়াপথটি থেকে আসা আলোকে বাঁকিয়ে দেবে এবং সংশ্লিষ্ট জ্যামিতির উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হবে বলয় বা আর্ক। মজার বিষয় হচ্ছে, অপেক্ষাকৃত কাছের স্তবক আলো বাঁকিয়ে আমাদের পক্ষে ছায়াপথ চিহ্নিত করা সহজ করে দিচ্ছে, কাজ করছে প্রাকৃতিক দুরবিন হিসেবে। সে না বাঁকালে কে জানে কোথায় যেতো সে আলো। কোনদিন হয়তো এই প্রাকৃতিক দুরবিন ব্যবহার করে আমরা মহাবিশ্বের দূরতম পদার্থর সন্ধান পেতে সক্ষম হবো।
কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে মাঝখানের হস্তক্ষেপকারী ছায়াপথ স্তবকের ভর নির্ণয় করা সম্ভব। আলোর পর্যবেক্ষণকৃত জ্যামিতিক বিক্ষেপণ ঘটার জন্য এই স্তবকে ঠিক কি পরিমাণ গুপ্ত পদার্থ থাকতে হবে তাও বের করা সম্ভব। দেখা গেছে প্রাপ্ত ফলাফল দিতে হলে স্তবকে যে পরিমাণ থাকা প্রয়োজন তা নেই। অর্থাৎ অধিকাংশ ভরই অদৃশ্য রয়ে গেছে।
এমনকি আমাদের ছায়াপথের গুপ্ত পদার্থগুলোও মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের মাধ্যমে আলোর গতিপথ বাঁকাতে পারে। গ্রহণের মাধ্যমে সামনের একটি পদার্থ যখন পেছনের কোন তারাকে আড়াল করে দেয় তখন, পেছনের তারা থেকে সামনের দিকে আসা আলো স্বাভাবিক পথ থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে সরু বলয়ের সৃষ্টি করে। এই বলয়ের ঔজ্জ্বল্য পেছনের তারার স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য থেকে অনেক বেশী হয়। এর ফলে তারার ঔজ্জ্বল্য প্রথমে কমে এবং পরে আবার বাড়ে। এই হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে সামনের গুপ্ত পদার্থর ভর নির্ণয় করা যায়।
কোথায় আছে গুপ্ত পদার্থ?
আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের বর্ণবলয়ে অবস্থিত “মাচো” (MACHO) নামক অদৃশ্য পদার্থের কারণে সৃষ্ট লেন্সিং ঘটনা পর্যবেক্ষণ করার জন্য অনেকগুলো গবেষক দল কাজ করছেন। মোটেই সহজ কাজ নয় এটি। প্রয়োজন ম্যাজেলানীয় মেঘ এবং অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথের লক্ষ লক্ষ তারা পর্যবেক্ষণ। গবেষণা সফল হলে আমাদের ছায়াপথের বর্ণবলয়ে বর্তমান গুপ্ত পদার্থর পরিমাণ নির্ণয় করা যাবে।
উপবৃত্তাকার এবং কুণ্ডলাকার ছায়াপথগুলো বিপুল পরিমাণ গুপ্ত পদার্থর মাঝে অবস্থান করে বলে জোড়ালো প্রমাণ পাওয়া গেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন তাই, এই গুপ্ত পদার্থর অবস্থান, পরিমাণ এবং বন্টন নিয়ে সবিশেষ চিন্তিত।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী ছায়াপথগুলোর পর্যবেক্ষণ ফলগুলো তুলনা করেন এবং একটি সারমর্মে আসার চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ মহাগোলার্ধে দৃশ্যমান ম্যাজেলানীয় মেঘের (দুটি স্যাটেলাইট ছায়াপথ) গতি পর্যবেক্ষণ করে জানা গেছে, তারা আকাশগঙ্গার বর্ণবলয়ের মধ্যে আবর্তন করে এবং এই বর্ণবলয় ম্যাজেলানীয় মেঘ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সে হিসেবে এই বলয়টি প্রায় ৩০০,০০০ আলোকবর্ষ দূরত্ব জুড়ে অবস্থান করে। এমনকি আমাদের ছায়াপথের সবচেয়ে দূরবর্তী বিচ্ছিন্ন পদার্থগুলো দেখে মনে হয়, এই বর্ণবলয় আরও দ্বিগুণ দূরত্বে বিস্তৃত থাকতে পারে। তথা, প্রায় ৬০০,০০০ আলোকবর্ষ দূরত্ব জুড়েও এর অবস্থান চিহ্নিত হতে পারে।
আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী কুণ্ডলাকার ছায়াপথ অ্যান্ড্রোমিডার দূরত্ব আমাদের থেকে মাত্র ২০০,০০০ আলোকবর্ষ। তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, আমাদের ছায়াপথের বর্ণবলয় অ্যান্ড্রোমিডা এবং এর বর্ণবলয়ের মধ্যেও কিছু স্থান অধিকার করে আছে। বিস্ময়ভরে বিজ্ঞানীরা আরও আবিষ্কার করেছেন, সুবিশাল ছায়াপথ স্তবকগুলোও তদপেক্ষা বিশাল গুপ্ত পদার্থবলয়ের মধ্যে গেঁথে আছে। সর্বোচ্চ যে দূরত্বের ছায়াপথগুলোর ভর নির্ণয় করা গেছে তাদের ক্ষেত্রে উপর্যুপরি পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখা গেছে, আলোকজ্জ্বল বামন পদার্থনিচয়ের তুলনায় গুপ্ত পদার্থর পরিমাণ কমপক্ষে ১০ গুণ। এটা বেড়ে ১০০ গুণ পর্যন্তও হতে পারে।
সর্বোপরী আমরা বিশ্বাস করি, গুপ্ত পদার্থর সাথে উজ্জ্বল পদার্থর হালকা হলেও একটা সম্পর্ক রয়েছে। কারণ এই দুই ধরণের পদার্থ কখনও কখনও একত্রে আবির্ভূত হয়। এটা অবশ্য পক্ষপাতিত্বমূলক পর্যবেক্ষণের কারণেও মনে হতে পারে। কারণ, উজ্জ্বল পদার্থর মাধ্যমেই সচরাচর গুপ্ত পদার্থর সন্ধান পাওয়া যায়।
কয়েক দশক ধরে খুব সতর্কভাবে ছায়াপথ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন, প্রতিটি ছায়াপথই সক্রিয়ভাবে বিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিবেশের অন্যান্য ছায়াপথের সাথে পারষ্পরিক মহাকর্ষীয় টানের কারণে এই বিবর্তন ঘটছে। কিন্তু ছায়াপথের মধ্যকার একক তারাগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব তাদের ব্যাসের তুলনায় অনেক বেশী। এ কারণে তারাগুলো মহাকর্ষের মাধ্যমে একে অপরকে খুব কমই প্রভাবিত করে। যেমন, সূর্য এবং এর সবচেয়ে নিকটবর্তী তারা প্রক্সিমা সেন্টরি এর মধ্যবর্তী দূরত্ব এতো বেশী যে, এর মধ্যে প্রায় ৩০০ কোটি সূর্যকে একের পর এক বসানো যাবে। কিন্তু ছায়াপথগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব তাদের ব্যাসের তুলনায় এতো বেশী নয়। একটি ছায়াপথের ব্যাসের কয়েক গুণের মধ্যে অন্য কোন না কোন ছায়াপথ থাকে। এ কারণেই ছায়াপথগুলো একে অপরকে মহাকর্ষীয়ভাবে প্রভাবিত করে। গুপ্ত পদার্থ যোগ করলে মিথস্ক্রিয়াজনিত এই প্রভাব আরও বেড়ে যায়।
ছায়াপথের বর্ধন, সঙ্কোচন, রূপান্তর এবং ধ্বংস পর্যবেক্ষণ করে যা বোঝা গেছে তা হল, গুপ্ত পদার্থ ধর্তব্যের মধ্যে না আনলে এই প্রক্রিয়াগুলো ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমাদের নিজেদের ছায়াপথীয় প্রতিবেশেও এ ধরণের মিথস্ক্রিয়া চলছে। আমাদের দ্বিতীয় নিকটতম প্রতিবেশী ছায়াপথ ম্যাজেলানীয় মেঘ প্রতি বিলিয়ন বছরে একবার করে আমাদের ছায়াপথের তলকে অতিক্রম করে। যাওয়ার পথে তারা জোয়ার-ভাটাজনিত জনিত লেজ চিহ্ন হিসেবে রেখে যায়, এই লেজের মধ্যে তারাও থাকতে পারে। প্রতিবার অতিক্রমের পরই তারা শক্তি হারায় এবং ভিতের দিকে কুণ্ডলিত হতে থাকে। আগামী ১০ বিলিয়ন বছরের মধ্যে এই ছায়াপথ খণ্ড খণ্ড হয়ে আকাশগঙ্গার (মিল্কি ওয়ে) সাথে মিলে যাবে।
সম্প্রতি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের আরও নিকটে অবস্থিত একটি ছায়াপথ খুঁজে পেয়েছেন যার নাম “ধনু রাশির বামন” (Sagittarius Dwarf)। এটি আকাশগঙ্গার দূরবর্তী পার্শ্বে বহিঃস্থ প্রান্তের কাছাকাছি অবস্থিত। পৃথিবী থেকে দেখলে এই ছায়াপথটিকে ধনু রাশির মধ্যে দেখা যায়, এ কারণেই এমন নামকরণ করা হয়েছে। আমাদের ছায়াপথের মহাকর্ষ বল এই বামন ছায়াপথকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে এবং কয়েকটি আবর্তনের পরই এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এমনও হতে পারে, এ ধরণের অনেকগুলো বামন ছায়াপথের সম্মিলনের মাধ্যমেই আমাদের ছায়াপথ বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
অনুরূপভাবে, এম৩১ এবং আকাশগঙ্গার একে অন্যের দিকে সেকেন্ডে ১৩০ কিলোমিটার (৮১ মাইল) বেগে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে, আর কয়েক দশকের মধ্যেই এই দুটি ছায়াপথ হয় একে অপরের উপর ধ্বসে পড়বে নয়তো পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। সুতরাং এই মোহনীয় ঘটনা পর্যবেক্ষণের সৌভাগ্য আমাদের হতেও পারে। খুশী হওয়ার কারণ অবশ্য নেই, কারণ এম৩১ এর আকার অপেক্ষাকৃত বড় হওয়ায় আকাশগঙ্গা তার মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মাধ্যমে দেখা গেছে, আগামী ৪ বিলিয়ন বছরের মধ্যে এই দুটি ছায়াপথ জোড় একসাথে মিলে একটি উপগোলাকার ছায়াপথে পরিণত হবে। এর অনেক আগেই অবশ্য আমাদের সূর্য নিভে যাবে। সুতরাং মহাবিশ্বের অন্য কোন প্রান্তের বুদ্ধিমান প্রাণীরা হয়তো সে প্রায়োটেকনিক ঘটনার সাক্ষ্য হতে পারবে, আমরা না।
অনেকগুলো কারণে, অন্যান্য বড় আকৃতির ছায়াপথের মত আমাদের ছায়াপথটিও প্রতিবেশীদের সাথে বেশ অভদ্র আচরণ করে। এটি প্রতিবেশের অনেক জ্যোতিষ্কই গিলে ফেলে এবং তা দিয়ে নিজের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় গাঠনিক একক নির্মাণ করে। আমাদের পৃথিবীর মহাদেশগুলো যেমন একটু একটু করে সরে যায় কেমনই বিবর্তিত হয়ে আমাদের ছায়াপথ। অনেকগুলো ছায়াপথের এ ধরণের ঘূর্ণন, কুণ্ডলী পাকিয়ে যাওয়া, পাক খেয়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় গতি এবং প্রত্যেকের গঠন অধ্যয়ন করে জ্যোতির্বিদরা নির্ণয় করতে পারেন, এই গতিময়তা বজায় রাখার জন্য কতটা মহাকর্ষ বলের প্রয়োজন। একই সাথে অনুমান করতে পারেন, কতটা অদৃশ্য তথা গুপ্ত পদার্থ থাকলে এই মহাকর্ষ বলের উদ্ভব হতে পারে।
মহাবিশ্বে কি পরিমাণ গুপ্ত পদার্থ রয়েছে? মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতি একটি মাত্র অজানা রাশির উপর নির্ভর করছে। সেটি হল মহাবিশ্বের মোট ভর। মহাবিশ্বের ঘনত্ব যদি বেশী হয় তাহলে মহাকর্ষ ক্রিয়ার প্রভাবে এক সময় এর প্রসারণ বন্ধ হয়ে যাবে এবং এটি সংকুচিত হতে শুরু করবে যাকে মহা সংকোচন বলে। মহাবিশ্বের এই অবস্থাকে বলে “বদ্ধ মহাবিশ্ব”। সংকোচনের পর আবার প্রসারণ শুরু হতে পারে। কিন্তু মহাবিশ্বের ঘনত্ব যদি কম হয়, তাহলে এটি আজীবন প্রসারিত হতে থাকবে। এ ধরণের মহাবিশ্বকে বলে “উন্মুক্ত মহাবিশ্ব”।
এ পর্যন্ত যতদূর পর্যবেক্ষণ করা গেছে তা উন্মুক্ত মহাবিশ্বকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ এটি আজীবন প্রসারিত হতে থাকবে। সকল দৃশ্যমান পদার্থ এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনুমানকৃত গুপ্ত পদার্থের পরিমাণ একসাথে যোগ করলে মোট যে ভর পাওয়া যায় তা মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ করার জন্য নেহাতই কম। প্রসারণ বন্ধ করতে হলে যে ঘনত্বের প্রয়োজন এই ঘনত্বের মান তার শতকরা মাত্র ২০ ভাগ।
আমি এখানে সংকোচন-প্রসারণের গল্প শেষ করে দিতে পারতাম যদি না বিশ্বতত্ত্ববিদরা উন্মুক্ত এবং বদ্ধ ছাড়া মহাবিশ্বের আরও এক ধরণের মডেল উত্থাপন করতেন। এই মডেল মোতাবেক মহাবিশ্বের একটি ক্রান্তি ঘনত্ব রয়েছে যা উচ্চ এবং নিম্নের মাঝামাঝি। এটি ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের ধারণা দেয় যার ঘনত্ব একেবারে সঠিক। বর্তমানে মোট পদার্থের যে পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে তা প্রসারণ বন্ধ করার উপযোগী নয়। তারপরও নতুন এই মডেল প্রস্তার করে, কোন একদিন এমন কিছু অজানা শক্তি বা পদার্থের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে যারা প্রসারণ বন্ধে সক্ষম। একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি মানতে বাধ্য যে, একসময় এই বিশাল শক্তির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তাই বলে, এই পরিস্থিতিতে আমি এমন কোন মহাজাগতিক মডেলকে মেনে নিতে পারি না যার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ এখনও করা সম্ভব হয় নি।
আরেকটি জটিলতা রয়েছে যা এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। সেটা হচ্ছে সম্পূর্ণ গুপ্ত কোন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকতে পারে- এমন ব্যবস্থা যেখানে কেবলই গুপ্ত পদার্থ থাকবে। দৃশ্যমান পদার্থের সাধ্য নেই সেই ব্যবস্থাকে ভেদ করার। বর্তমানে আমরা জানি না আদৌ কোন অদৃশ্য পদার্থ ব্যবস্থার অস্তিত্ব আছে কি-না। পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এর সম্ভাবনা উড়িয়েও দেয়া যায় না, আবার মেনেও নেয়া যায় না।
কি এই গুপ্ত পদার্থ?
গুপ্ত পদার্থ যেমনই হোক না কেন, একটা বিষয় নিশ্চিত যে মহাবিশ্বে এই পদার্থ বিপুল পরিমাণে রয়েছে। প্রতি গ্রাম দৃশ্যমান পদার্থের বিপরীতে হয়তো দশ গ্রাম বা তার চেয়েও বেশী গুপ্ত পদার্থ আছে। জ্যোতির্বৈজ্ঞানের বিচারে এখনও বোঝা যায় নি, কি দিয়ে এই পদার্থ গঠিত। কেউ এমনও বলতে পারেন, আমরা গুপ্ত পদার্থ পর্যবেক্ষণের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। গুপ্ত পদার্থের গাঠনিক উপাদানের দাবী করতে পারে এমন বেশ কিছু অদৃশ্য ভর রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু একেবারে সাধারণ, কিছু কিছু আবার বেশ উদ্ভট।
আরেকটি বিষয় হল, বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করার কোন অবকাশ এখানে নেই। পদার্থের উৎপত্তির প্রচলিত কাঠামোতেই আমাদের কাজ করতে হবে। মহা বিস্ফোরণের পর মৌলিক পদার্থের উৎপত্তি বিষয়ে কেন্দ্রিন সংশ্লেষ (Nucleosynthesis) নামে যে প্রক্রিয়া রয়েছে তাই হতে পারে কাঠামো। মহাবিশ্বে সাধারণ পদার্থের কি পরিমাণ বেরিয়ন-কণা থাকতে পারে তার একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয় এই প্রক্রিয়া। আদি মহাবিশ্বের প্রমিত মডেল থেকে এই সীমার মান পাওয়া যায়। এই মডেলের একটি উন্মুক্ত রাশি আছে- বেরিয়ন এবং ফোটনের পরিমাণের অনুপাত।
মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের তাপমাত্রা থেকে ফোটনের মোট সংখ্যা জানা গেছে। এখন, বেরিয়নের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই তারা এবং ছায়াপথগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। হালকা কেন্দ্রিনের (Nuclei) মহাজাগতিক প্রাচুর্য বিষয়ে জানার জন্যই এই পর্যবেক্ষণ। কারণ হালকা কেন্দ্রিন একমাত্র উপাদান যা মহা বিস্ফোরণের পরপরই গঠিত হয়েছিল।
কেন্দ্রিন সংশ্লেষের সীমা অতিক্রম না করেই আমরা একটি স্বল্প ঘনত্ববিশিষ্ট উন্মুক্ত মহাবিশ্বের গ্রহণযোগ্য মডেল তৈরী করতে পারি। এই মডেলে আমরা বেরিয়ন এবং অদ্ভুত পদার্থের (নন-বেরিয়নিক কণা) পরিমাণ প্রায় সমান হিসেবে ধরতে পারি। কিন্তু এগুলো মিলিয়েও বদ্ধ মহাবিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় ভরের শতকরা মাত্র ২০ ভাগের সন্ধান পাওয়া যায়। মহাবিশ্বের এই মডেল আমাদের প্রকৃত সবগুলো পর্যবেক্ষণের সাথেই মিলে যায়। অপরদিকে এই মডেলে সামান্য পরিবর্তন এনে যদি উন্মুক্ত মহাবিশ্বের মডেল করে দেয়া হয় তাহলেও তা পর্যবেক্ষণগুলোর পক্ষেই যায়। উন্মুক্ত মডেলের ক্ষেত্রে সকল পদার্থই বেরিয়নিক। দুর্ভাগ্যবশত, উন্মুক্ত মহাবিশ্বের এই বিকল্প মডেলে বেরিয়নের পরিমাণ এতো বেশী যে তা কেন্দ্রিন সংশ্লেষের সীমাকে অতিক্রম করে। সেহেতু, নিম্ন ঘনত্ববিশিষ্ট বদ্ধ মহাবিশ্বের মডেলে বেশ রহস্যজনক কিছু ধর্ম রয়েছে: মহাবিশ্বের অধিকাংশ বেরিয়নই অদৃশ্য থাকবে এবং তাদের প্রকৃতি সম্বন্ধে জানা যাবে না। আর অধিকাংশ মডেলেই মহাবিশ্বের পদার্থগুলো প্রকৃতি অদ্ভূত এবং অজানা।
অদ্ভুত কণা
তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা গুপ্ত পদার্থের গাঠনিক উপাদান হিসেবে অনেকগুলো বস্তুকেই নির্দেশ করেছেন। অবশ্য এই বিচিত্র বস্তুর মধ্যে অনেকগুলোই পর্যবেক্ষণের অতীত। বেরিয়নিক গুপ্ত পদার্থের গাঠনিক উপাদান হিসেবে ডে সমস্ত বস্তুর উদাহরণ টানা হয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে: কৃষ্ণ বিবর (বড় এবং ছোট), ধূসর বামন (এতোটা শীতল ও মৃয়মান তারা যারা যথেষ্ট আলো বিকিরণ করতে পারে না), সূর্যের সমান আকৃতির ম্যাচো (MACHO), শীতল গ্যাস, গুপ্ত ছায়াপথ এবং গুপ্ত স্তবক।
এতো গেল বেরিয়নিক গুপ্ত পদার্থের কথা। নন-বেরিয়নিক গুপ্ত পদার্থের গাঠনিক উপাদানগুলো এখনও তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কল্পনার জগতেই রয়ে গেছে। এ ধরণের অনেকগুলো কণার মধ্যে কয়েকটি হল: ফোটিনো, নিউট্রিনো, গ্র্যাভিটন, অ্যাক্সিয়ন এবং চৌম্বক একমেরু। এগুলোর মধ্যে সনাক্তকারীরা কেবল নিউট্রিনো চিহ্নিত করতে পেরেছেন। নিউট্রিনোর আদৌ কোন ভর আছে কি-না সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নন। অন্যান্য অদ্ভূত কণা চিহ্নিত করার জন্য সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া চলছে। আসলেই যদি তাদের অস্তিত্ব থাকে এবং তাদের ভর যদি আশানুরূপ সীমার মধ্যে পড়ে তাহলে সেগুলোই হতে পারে গুপ্ত পদার্থের গাঠনিক উপাদান। অবশ্য আশাগুলো একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে।
ব্যাপক অর্থে চিন্তা করলে, ছায়াপথ এবং স্তবকের বিবর্তন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার জন্য আগে গুপ্ত পদার্থের ধর্ম সম্বন্ধে জানতে হবে। এই ধর্মগুলো না জানলে, ছায়অপথগুলো বিবর্তিত হয়ে কিভাবে বর্তমান অবস্থায় এসেছে তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না।আদি মহাবিশ্ব বিষয়ে আমাদের জ্ঞান যেহেতু প্রতিনিয়তই বাগছে, সেহেতু আশা করা যায় অচিরেই ছায়াপথের গঠন এবং গুপ্ত পদার্থ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত জানতে পারব।
আমাদের চোখ বা সনাক্তকারী যন্ত্রের মাধ্যমে যা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সহায়তায় সে সম্বন্ধে উপলব্ধি করা সম্ভব। গুপ্ত পদার্থ সন্ধানের ক্ষেত্রে বর্তমানে কম্পিউটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এতোদিন মূলত পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করতেন। বর্তমানে পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানের উপর সেই গুরুত্বটি দেয়া হচ্ছে। বর্তমানের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণগুলো গবেষণাগারের টেবিল বা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের লেন্সে কাজ করে না, কাজ করে কম্পিউটার টার্মিনালে। বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারের মাধ্যমে মহাজাগতিক সিম্যুলেশন তৈরী করেন। এই সিম্যুলেশনে হাজার হাজার বিন্দুর মাধ্যমে তারা, গ্যাস এবং গুপ্ত পদার্থকে নির্দেশ করা হয়। তারপর একটি ছায়াপথের সমগ্র জীবনের ব্যাপ্তীতে এই বিন্দুগুলোর মিথস্ক্রিয়া ঘটানো হয়। বিশ্বত্ত্ববিদরা সিম্যুলেশনে গুপ্ত পদার্থের পরিমাণ পরিবর্তন করে দেখতে পারেন, বিচ্ছিন্ন ভার্চুয়াল ছায়াপথের উপর তার কি প্রভাব পড়ে। বিচ্ছিন্ন ছায়াপথের বদলে সিম্যুলেশনের মাধ্যশে অনেক ছায়াপথের ভীড়ও তৈরী করা যায়।
এ হিসেবে কম্পিউটার মডেল ছায়াপথের ব্যবহার সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দুইটি ছায়াপথ যখন খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করে তখন দুই ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে। এক হয়তো তারা তীব্র সংঘর্ষের মাধ্যমে একে অপরের উপর ধ্বসে পড়তে পারে অথবা সামান্য স্পর্শ করে চলে যেতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই মাঝেমাঝে জোয়ার-ভাটাজনিত দীর্ঘ লেজের সৃষ্টি হয়। বর্তমান মডেলগুলোর মাধ্যমে জানা গেছে, ছায়াপথের বর্ণবলয়ে দৃশ্যমান পদার্থের তুলনায় গুপ্ত পদার্থের পরিমাণ ৩ থেকে ১০ গুণ বেশী হলেই কেবল এ ধরণের লেজ তৈরী হওয়া সম্ভব। বর্ণবলয় যত ভারী হয় লেজ ততই খাটো এবং মোটা হয়। কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে এই তথ্য পাওয়া গেছে এবং এটি বেশ কিছু ক্ষেত্রে জ্যোতির্বেজ্ঞানীদেরকে সহায়তা করেছে। এর মাধ্যমে ছায়াপথকে এরকম দেখা যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করা যায় এবং যে গুপ্ত পদার্থ দেখা যায় না সে সম্বন্ধেও এ থেকে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেন তারা। বিশ্বতত্ত্বের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত কম্পিউটার সিম্যুলেশন পর্যবেক্ষণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
চিন্তা করার নিত্য নতুন পদ্ধতির পাশাপাশি নতুন নতুন যন্ত্র ও প্রযুক্তিগুলো স্বর্গ সম্বন্ধে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি বাড়িয়ে চলেছে। আজ থেকে মাত্র ৪০০ বছর আগে গ্যালিলিও একটি কার্ডবোর্ড টিউবের এক পাশে রেখেছিলেন একটি লেন্স, আর অন্য পাশে একটি বড় মস্তিষ্ক স্থাপন করে রহস্যময় স্বর্গের ভুবনে বিচরণ করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আকাশজুড়ে আকাশগঙ্গা নামে পরিচিত যে মৃয়মান আলোর ডোরা দেখা যায় তা আসলে কোটি কোটি একক তারা ও তারা স্তবক দিয়ে গঠিত। তৎক্ষণাৎ, মানুষ বুঝতে পারলো ছায়াপথ কাকে বলে। এম তো হতেই পারে যে, আগামী শতাব্দীতে আরেকটি বৃহৎ মস্তিষ্ক (যার এখনও জন্ম হয়নি), লেন্সের চেয়ে অনেকগুণ চটপটে ও কর্মক্ষম যন্ত্রের এক পাশে তার চোখ স্থাপন করবে এবং অবশ্যই গুপ্ত পদার্থ কি, এই প্রশ্নের উত্তর বের করে নিয়ে আসবে।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সেখানে স্তুপ করে রাখা অনেকগুলো ম্যাচের বাক্স খুঁজে পেলেন। একটি ম্যাচ ধরালেন, কিন্তু জ্বলে উঠার সাথে সাথেই তা মিইয়ে গেল। প্রতিটি কাঠিই ধরানোর অল্প সময়ের মধ্যে নিভে যেতে লাগলো। কিন্তু, তখনই বুঝতে পারলেন, কাঠিটি যে অল্প সময় জ্বলে থাকে ততক্ষণে পরিপার্শ্বের কিছুটা আপনি দেখে নিতে পারেন। পরের ম্যাচটি জ্বেলে উল্টোদিকে একটি দেয়াল দেখতে পেলেন। আরেকটি ম্যাচ জ্বেলে দেখতে পেলেন অদ্ভুত ছায়া যা সেখানে বৃহদাকার কোন বস্তুর উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। পরের ম্যাচ জ্বেলে বুঝতে পারলেন আপনি স্থির নন, হয় আপনি চলমান আছেন নয়তো আপনার সাপেক্ষে কক্ষটি চলমান। এভাবে প্রতিটি ক্ষণস্থায়ী অগ্নিশিখায় একটু একটু করে আপনার জানার পরিধি বাড়তে লাগলো।
স্থূল অর্থে, এই পরিস্থিতি পৃথিবীতে আমাদের ধাঁধাময় অবস্থাকেই নির্দেশ করে। বহু শতাব্দী ধরে যা করছিলাম, এখনও আমরা তা করে যাচ্ছি, আমাদের গ্রহীয় প্লাটফর্মে দাড়িয়ে রাতের আকাশে সজাগ দৃষ্টি মেলে বুঝতে চেষ্টা করছি, গুহাসম এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান কোথায়। ক্ষণকালের স্ফূলিঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, মহাকাশে সুবৃহৎ কিছু পদার্থ রয়েছে। এবং এই পদার্থগুলোর গতি ও আপাত ছায়া বলে দিচ্ছে, আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে আরও অনেক বেশী কিছু।
মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্ত থেকে আসা প্রতিটি ফোটন থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহের জোড় প্রচেষ্টা চালাই। স্বর্গ থেকে যে আলো পৃথিবীতে আসে তার অধ্যয়নকেই বলা হয় জ্যোতির্বিজ্ঞান। ভূমিস্থিত ও মহাকাশে ঘূর্ণায়মান দুরবিন থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ আলো সংগ্রহই কেবল আমাদের কাজ নয়, বরং এই আলোর মাধ্যমে মহাবিশ্বে দৃশ্যমান পদার্থনিচয়ের তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে গুপ্ত পদার্থগুলো সম্বন্ধে ধারণা লাভই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। অদৃশ্য বলতে বুঝাচ্ছি, যা দৃশ্যমান নয় কিন্তু আমাদের জানা তথ্যমতে তার উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী।
মহাবিশ্বের প্রসারণ ও ছায়াপথ সংশ্লিষ্ট ৫০ বছরের উপাত্ত একসাথে নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মহাবিশ্বের শতকরা অন্তত ৯০ ভাগ পদার্থ বা কণাই আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। অন্য কথায়, মহাবিশ্বের অধিকাংশ পদার্থই বিকিরণ করে না- তড়িচ্চুম্বকীয় বর্ণালিতে ধারণক্ষম কোন কিরণও তারা প্রদান করে না। প্রায় ৬০ বছর পূর্বে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিৎস ৎসুইকি সর্বপ্রথম এ ধরণের পদার্থর কথা বলেছিলেন। এরা ছায়াপথ স্তবকের কেন্দ্রে অবস্থিত বলে তিনি অনুমান করেছিলেন। এগুলোকে তিনি তথাকথিত নিরুদ্দিষ্ট পদার্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এই নিরুদ্দিষ্ট ভরকে এখন আমরা “গুপ্ত পদার্থ” (Dark Matter) বলি, কারণ ভর নয় বরং আলোই এখানে নিরুদ্দিষ্ট।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পদার্থবিদরা এই গুপ্ত পদার্থের অনেক ধরণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একপক্ষ বলেন, এরা সাধারণ পদার্থের মতোই; যেমন- অতি ক্ষীণ তারা, ছোট বা বড় কৃষ্ণ বিবর, শীতল গ্যাস বা মহাবিশ্বে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা ধূলিরাশি, যারা এতো ক্ষীণ বিকিরণ নিঃসরণ বা প্রতিফলন করে যে আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়েনা। এমনকি এরা একটি নির্দিষ্ট ধরণের গুপ্ত পদার্থও হতে পারে যাদেরকে “ম্যাচো” (MACHO – MAssive Compact Halo Objects) বলা হয়। ছায়াপথ বা ছায়াপথ স্তবক ঘিরে থাকা বর্ণবলয়ে এই ম্যাচোগুলো অদৃশ্যভাবে ওত পেতে থাকে। অন্য বিজ্ঞানীরা বলেন, গুপ্ত পদার্থ এমন ধরণের বহিরাগত বা অপরিচিত পদার্থ ও কণা যা পর্যবেক্ষণ করার মত প্রযুক্তি আমরা এখনও উদ্ভাবন করতে পারিনি। পদার্থবিজ্ঞানীরা এ সম্বন্ধে অনেক তত্ত্বকথা বললেও পরীক্ষণের মাধ্যমে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়নি। তৃতীয় আরেকটি সম্ভাবনা হল, অভিকর্ষ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অনেকটাই ভুল পথে এগোচ্ছে এবং এর বড় রকমের পরিবর্তন আবশ্যক। অবশ্য অধিকাংশ পদার্থবিজ্ঞানীই এ ধরণের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছেন।
একদিক থেকে চিন্তা করলে, গুপ্ত পদার্থর ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা বিশ্বতত্ত্বের অন্যান্য অসাধারণ কিছু বিষয়ের সাথে জট পাকিয়ে গেছে যা ছাড়ানোও কষ্টসাধ্য। যেমন- মহাবিশ্ব কতোটা ভর ধারণ করে, ছায়াপথগুলো কিভাবে গঠিত হয়েছিল এবং মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে প্রসারিত হতে থাকবে কি-না। মহাবিশ্বের আকার, আকৃতি ও চূড়ান্ত পরিণতি বোঝার জন্য গুপ্ত পদার্থ এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, আগামী কয়েক দশক ধরে এটিই জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণার মুখ্য বিষয় হয়ে থাকবে।
অদৃশ্যকে পর্যবেক্ষণ
যা দেখা যায়না তা বুঝতে পারা বেশ কষ্টকর হলেও অসম্ভব নয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আজকাল পর্যবেক্ষণযোগ্য পদার্থর উপর গুপ্ত পদার্থর প্রভাব নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে গুপ্ত পদার্থ অধ্যয়ন চালিয়ে যাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, নিকটবর্তী একটি তারাকে যখন সুনির্দিষ্ট তাত্ত্বিক কারণে কম্পিত হতে দেখি, তখন হিসাব কষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, একটি “গুপ্ত গ্রহ” তাকে প্রদক্ষিণ করছে। কুণ্ডলাকার ছায়াপথের ক্ষেত্রে আমরা একই পদ্ধতিতে গুপ্ত পদার্থের উপস্থিতির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। কারণ এই গুপ্ত পদার্থের কারণেই ছায়াপথের তারাগুলো অমোচনীয় গতিতে নিজ নিজ পথে গতিশীল থাকে।
কুণ্ডলাকার ছায়াপথকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান তারা ও গ্যাসীয় মেঘের কক্ষপথ পর্যবেক্ষণ করে আমরা দেখতে পাই, তাদের গতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশী। এই অপ্রত্যাশিত উচ্চ বেগই বুঝিয়ে দেয়, ছায়াপথের দৃশ্যমান পদার্থগুলোর চেয়ে অনেক বেশী কিছু থেকে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় টান সেখানে উপস্থিত রয়েছে। গতির বিস্তারিত পরিমাপের মাধ্যমে আমরা সিদ্ধান্তে এসেছি, বিপুল পরিমাণ গুপ্ত পদার্থ কর্তৃক প্রয়োগকৃত মহাকর্ষ বলই তারা ও গ্যাসীয় মেঘগুলিকে উচ্চ গতির কক্ষপথে ধরে রাখছে। আমরা প্রতিপাদন করেছি যে, গুপ্ত পদার্থ ছায়াপথ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এই পদার্থর উপস্থিতি ছায়াপথের দৃশ্যমান প্রান্ত থেকে শুরু করে আলোকজ্জ্বল ছায়াপথীয় চাকতির উপর নিচ পুরোটা জুড়েই রয়েছে। স্থুল অনুমিতির সাহায্যে বলা যায়, আমাদের আকাশগঙ্গার মত আদর্শ কুণ্ডলাকার ছায়াপথ অপেক্ষাকৃত সমতল দেদীপ্যমান চাকতি হিসেবে গুপ্ত পদার্থর একটি গোলকীয় বর্ণবলয়ে দৃঢ়ভাবে গেঁথে আছে- অনেকটা অতি মাত্রায় বিক্ষিপ্ত মেঘের মত।
ছায়াপথের মধ্যস্থিত প্রত্যেকটি তারার ছায়াপথীয় কেন্দ্রকে ঘিরে এতো দ্রুত গতিতে আবর্তন করতে হলে, ছায়াপথের মহাকর্ষ সৃষ্টিকারী যে পরিমাণ ভর থাকা প্রয়োজন তার মাত্র দশ ভাগের এক ভাগের হদিস পাওয়া যায়। একটি নির্দিষ্ট ছায়াপথের দিকে লক্ষ্য করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এটি বুঝতে পেরেছেন। সেই ছায়াপথের প্রায় ৫০,০০০ আলোবর্ষের মত ব্যাসার্ধ্যের মধ্যে তাই বিপুল পরিমাণ পদার্থ আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে।
ছায়াপথের একটি স্তবকে গুপ্ত পদার্থের পরিমাণ ও বণ্টন আবিষ্কার করতে গিয়ে এক্স-রশ্মি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, স্তবকের মধ্যস্থিত ছায়াপথগুলো ১০০ মিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রার বিক্ষিপ্ত গ্যাসের মধ্যে নিমজ্জিত অবস্থায় ভাসতে থাকে। এই উচ্চ তাপমাত্রার গ্যাসের শক্তি অনেক বেশী হলেও তাদেরকে চিহ্নিত করা বেশ কষ্টকর। আলোকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যেমন একটি নির্দিষ্ট ছায়াপথের তারাসমূহের বেগ ব্যবহার করেন তেমনই এক্স-রশ্মি পর্যবেক্ষকরা এই রশ্মি নিঃসরণকারী গ্যাসের তাপমাত্রা এবং প্রাচুর্যকে ব্যবহার করতে শিখেছেন। উভয় ক্ষেত্রেই প্রাপ্ত উপাত্তসমূহ দৃষ্টির আড়ালে থাকা পদার্থর প্রকৃতি ও অবস্থান বিষয়ক তথ্য সরবরাহ করে।
ছায়াপথের একটি স্তবকে এক্স-রশ্মি নিঃসরণকারী অঞ্চলের পরিমাণ এবং গ্যাসের তাপমাত্রা পরিমাপ করার মাধ্যমে আমরা স্তবকের ব্যাসার্ধ্যের মধ্যে উপস্থিত মহাকর্ষক ভরের মোট পরিমাণ অনুমান করতে পারি। স্তবকের ব্যাসার্ধ্য প্রায় ১০০ মিলিয়ন আলোক বর্ষের মতো হয়ে থাকে। আদর্শ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে, স্তবকের মধ্যস্থিত দেদীপ্যমান পদার্থ এবং এক্স-রশ্মি নিঃসরণকারী উত্তপ্ত গ্যাসের মোট পরিমাণ একসাথে করলেও তা স্তবকের মোট মহাকর্ষক ভরের শতকরা মাত্র ২০ থেকে ৩০ ভাগ হয়। অবশিষ্টাংশ তথা গুপ্ত পদার্থ নামে পরিচিত অংশ তখনও বর্তমান যন্ত্রপাতির পক্ষে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়ে উঠেনা।
অদৃশ্য পদার্থ চিহ্নিত করার সূক্ষ্ণতর পদ্ধতি বর্তমানে উদ্ভাবিত হয়েছে। একটি মজার পদ্ধতি হচ্ছে ছায়াপথ স্তবকের চারদিকে বলয় বা আর্ক চিহ্নিত করা যাদেরকে “আইনস্টাইন বলয়” বলা হয়। মহাকর্ষীয় লেন্সিং নামক ক্রিয়ার কারণে এই বলয়ের সৃষ্টি হয়। একটি সুবৃহৎ পদার্থর মহাকর্ষ যখন এর কাছ দিয়ে যাওয়া আলোকে বাঁকিয়ে দেয় তখনই মহাকর্ষীয় লেন্সিং ক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ ধরি, একটি ছায়াপথ স্তবক আরও দূরের অন্য একটি ছায়াপথকে আমাদের থেকে আড়াল করে দিয়েছে। এখন স্তবকটির মহাকর্ষ দূরের ছায়াপথটি থেকে আসা আলোকে বাঁকিয়ে দেবে এবং সংশ্লিষ্ট জ্যামিতির উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হবে বলয় বা আর্ক। মজার বিষয় হচ্ছে, অপেক্ষাকৃত কাছের স্তবক আলো বাঁকিয়ে আমাদের পক্ষে ছায়াপথ চিহ্নিত করা সহজ করে দিচ্ছে, কাজ করছে প্রাকৃতিক দুরবিন হিসেবে। সে না বাঁকালে কে জানে কোথায় যেতো সে আলো। কোনদিন হয়তো এই প্রাকৃতিক দুরবিন ব্যবহার করে আমরা মহাবিশ্বের দূরতম পদার্থর সন্ধান পেতে সক্ষম হবো।
কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে মাঝখানের হস্তক্ষেপকারী ছায়াপথ স্তবকের ভর নির্ণয় করা সম্ভব। আলোর পর্যবেক্ষণকৃত জ্যামিতিক বিক্ষেপণ ঘটার জন্য এই স্তবকে ঠিক কি পরিমাণ গুপ্ত পদার্থ থাকতে হবে তাও বের করা সম্ভব। দেখা গেছে প্রাপ্ত ফলাফল দিতে হলে স্তবকে যে পরিমাণ থাকা প্রয়োজন তা নেই। অর্থাৎ অধিকাংশ ভরই অদৃশ্য রয়ে গেছে।
এমনকি আমাদের ছায়াপথের গুপ্ত পদার্থগুলোও মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের মাধ্যমে আলোর গতিপথ বাঁকাতে পারে। গ্রহণের মাধ্যমে সামনের একটি পদার্থ যখন পেছনের কোন তারাকে আড়াল করে দেয় তখন, পেছনের তারা থেকে সামনের দিকে আসা আলো স্বাভাবিক পথ থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে সরু বলয়ের সৃষ্টি করে। এই বলয়ের ঔজ্জ্বল্য পেছনের তারার স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য থেকে অনেক বেশী হয়। এর ফলে তারার ঔজ্জ্বল্য প্রথমে কমে এবং পরে আবার বাড়ে। এই হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে সামনের গুপ্ত পদার্থর ভর নির্ণয় করা যায়।
কোথায় আছে গুপ্ত পদার্থ?
আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের বর্ণবলয়ে অবস্থিত “মাচো” (MACHO) নামক অদৃশ্য পদার্থের কারণে সৃষ্ট লেন্সিং ঘটনা পর্যবেক্ষণ করার জন্য অনেকগুলো গবেষক দল কাজ করছেন। মোটেই সহজ কাজ নয় এটি। প্রয়োজন ম্যাজেলানীয় মেঘ এবং অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথের লক্ষ লক্ষ তারা পর্যবেক্ষণ। গবেষণা সফল হলে আমাদের ছায়াপথের বর্ণবলয়ে বর্তমান গুপ্ত পদার্থর পরিমাণ নির্ণয় করা যাবে।
উপবৃত্তাকার এবং কুণ্ডলাকার ছায়াপথগুলো বিপুল পরিমাণ গুপ্ত পদার্থর মাঝে অবস্থান করে বলে জোড়ালো প্রমাণ পাওয়া গেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন তাই, এই গুপ্ত পদার্থর অবস্থান, পরিমাণ এবং বন্টন নিয়ে সবিশেষ চিন্তিত।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী ছায়াপথগুলোর পর্যবেক্ষণ ফলগুলো তুলনা করেন এবং একটি সারমর্মে আসার চেষ্টা করেন। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ মহাগোলার্ধে দৃশ্যমান ম্যাজেলানীয় মেঘের (দুটি স্যাটেলাইট ছায়াপথ) গতি পর্যবেক্ষণ করে জানা গেছে, তারা আকাশগঙ্গার বর্ণবলয়ের মধ্যে আবর্তন করে এবং এই বর্ণবলয় ম্যাজেলানীয় মেঘ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সে হিসেবে এই বলয়টি প্রায় ৩০০,০০০ আলোকবর্ষ দূরত্ব জুড়ে অবস্থান করে। এমনকি আমাদের ছায়াপথের সবচেয়ে দূরবর্তী বিচ্ছিন্ন পদার্থগুলো দেখে মনে হয়, এই বর্ণবলয় আরও দ্বিগুণ দূরত্বে বিস্তৃত থাকতে পারে। তথা, প্রায় ৬০০,০০০ আলোকবর্ষ দূরত্ব জুড়েও এর অবস্থান চিহ্নিত হতে পারে।
আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী কুণ্ডলাকার ছায়াপথ অ্যান্ড্রোমিডার দূরত্ব আমাদের থেকে মাত্র ২০০,০০০ আলোকবর্ষ। তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, আমাদের ছায়াপথের বর্ণবলয় অ্যান্ড্রোমিডা এবং এর বর্ণবলয়ের মধ্যেও কিছু স্থান অধিকার করে আছে। বিস্ময়ভরে বিজ্ঞানীরা আরও আবিষ্কার করেছেন, সুবিশাল ছায়াপথ স্তবকগুলোও তদপেক্ষা বিশাল গুপ্ত পদার্থবলয়ের মধ্যে গেঁথে আছে। সর্বোচ্চ যে দূরত্বের ছায়াপথগুলোর ভর নির্ণয় করা গেছে তাদের ক্ষেত্রে উপর্যুপরি পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখা গেছে, আলোকজ্জ্বল বামন পদার্থনিচয়ের তুলনায় গুপ্ত পদার্থর পরিমাণ কমপক্ষে ১০ গুণ। এটা বেড়ে ১০০ গুণ পর্যন্তও হতে পারে।
সর্বোপরী আমরা বিশ্বাস করি, গুপ্ত পদার্থর সাথে উজ্জ্বল পদার্থর হালকা হলেও একটা সম্পর্ক রয়েছে। কারণ এই দুই ধরণের পদার্থ কখনও কখনও একত্রে আবির্ভূত হয়। এটা অবশ্য পক্ষপাতিত্বমূলক পর্যবেক্ষণের কারণেও মনে হতে পারে। কারণ, উজ্জ্বল পদার্থর মাধ্যমেই সচরাচর গুপ্ত পদার্থর সন্ধান পাওয়া যায়।
কয়েক দশক ধরে খুব সতর্কভাবে ছায়াপথ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন, প্রতিটি ছায়াপথই সক্রিয়ভাবে বিবর্তিত হচ্ছে। প্রতিবেশের অন্যান্য ছায়াপথের সাথে পারষ্পরিক মহাকর্ষীয় টানের কারণে এই বিবর্তন ঘটছে। কিন্তু ছায়াপথের মধ্যকার একক তারাগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব তাদের ব্যাসের তুলনায় অনেক বেশী। এ কারণে তারাগুলো মহাকর্ষের মাধ্যমে একে অপরকে খুব কমই প্রভাবিত করে। যেমন, সূর্য এবং এর সবচেয়ে নিকটবর্তী তারা প্রক্সিমা সেন্টরি এর মধ্যবর্তী দূরত্ব এতো বেশী যে, এর মধ্যে প্রায় ৩০০ কোটি সূর্যকে একের পর এক বসানো যাবে। কিন্তু ছায়াপথগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব তাদের ব্যাসের তুলনায় এতো বেশী নয়। একটি ছায়াপথের ব্যাসের কয়েক গুণের মধ্যে অন্য কোন না কোন ছায়াপথ থাকে। এ কারণেই ছায়াপথগুলো একে অপরকে মহাকর্ষীয়ভাবে প্রভাবিত করে। গুপ্ত পদার্থ যোগ করলে মিথস্ক্রিয়াজনিত এই প্রভাব আরও বেড়ে যায়।
ছায়াপথের বর্ধন, সঙ্কোচন, রূপান্তর এবং ধ্বংস পর্যবেক্ষণ করে যা বোঝা গেছে তা হল, গুপ্ত পদার্থ ধর্তব্যের মধ্যে না আনলে এই প্রক্রিয়াগুলো ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমাদের নিজেদের ছায়াপথীয় প্রতিবেশেও এ ধরণের মিথস্ক্রিয়া চলছে। আমাদের দ্বিতীয় নিকটতম প্রতিবেশী ছায়াপথ ম্যাজেলানীয় মেঘ প্রতি বিলিয়ন বছরে একবার করে আমাদের ছায়াপথের তলকে অতিক্রম করে। যাওয়ার পথে তারা জোয়ার-ভাটাজনিত জনিত লেজ চিহ্ন হিসেবে রেখে যায়, এই লেজের মধ্যে তারাও থাকতে পারে। প্রতিবার অতিক্রমের পরই তারা শক্তি হারায় এবং ভিতের দিকে কুণ্ডলিত হতে থাকে। আগামী ১০ বিলিয়ন বছরের মধ্যে এই ছায়াপথ খণ্ড খণ্ড হয়ে আকাশগঙ্গার (মিল্কি ওয়ে) সাথে মিলে যাবে।
সম্প্রতি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের আরও নিকটে অবস্থিত একটি ছায়াপথ খুঁজে পেয়েছেন যার নাম “ধনু রাশির বামন” (Sagittarius Dwarf)। এটি আকাশগঙ্গার দূরবর্তী পার্শ্বে বহিঃস্থ প্রান্তের কাছাকাছি অবস্থিত। পৃথিবী থেকে দেখলে এই ছায়াপথটিকে ধনু রাশির মধ্যে দেখা যায়, এ কারণেই এমন নামকরণ করা হয়েছে। আমাদের ছায়াপথের মহাকর্ষ বল এই বামন ছায়াপথকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে এবং কয়েকটি আবর্তনের পরই এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এমনও হতে পারে, এ ধরণের অনেকগুলো বামন ছায়াপথের সম্মিলনের মাধ্যমেই আমাদের ছায়াপথ বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
অনুরূপভাবে, এম৩১ এবং আকাশগঙ্গার একে অন্যের দিকে সেকেন্ডে ১৩০ কিলোমিটার (৮১ মাইল) বেগে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে, আর কয়েক দশকের মধ্যেই এই দুটি ছায়াপথ হয় একে অপরের উপর ধ্বসে পড়বে নয়তো পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। সুতরাং এই মোহনীয় ঘটনা পর্যবেক্ষণের সৌভাগ্য আমাদের হতেও পারে। খুশী হওয়ার কারণ অবশ্য নেই, কারণ এম৩১ এর আকার অপেক্ষাকৃত বড় হওয়ায় আকাশগঙ্গা তার মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মাধ্যমে দেখা গেছে, আগামী ৪ বিলিয়ন বছরের মধ্যে এই দুটি ছায়াপথ জোড় একসাথে মিলে একটি উপগোলাকার ছায়াপথে পরিণত হবে। এর অনেক আগেই অবশ্য আমাদের সূর্য নিভে যাবে। সুতরাং মহাবিশ্বের অন্য কোন প্রান্তের বুদ্ধিমান প্রাণীরা হয়তো সে প্রায়োটেকনিক ঘটনার সাক্ষ্য হতে পারবে, আমরা না।
অনেকগুলো কারণে, অন্যান্য বড় আকৃতির ছায়াপথের মত আমাদের ছায়াপথটিও প্রতিবেশীদের সাথে বেশ অভদ্র আচরণ করে। এটি প্রতিবেশের অনেক জ্যোতিষ্কই গিলে ফেলে এবং তা দিয়ে নিজের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় গাঠনিক একক নির্মাণ করে। আমাদের পৃথিবীর মহাদেশগুলো যেমন একটু একটু করে সরে যায় কেমনই বিবর্তিত হয়ে আমাদের ছায়াপথ। অনেকগুলো ছায়াপথের এ ধরণের ঘূর্ণন, কুণ্ডলী পাকিয়ে যাওয়া, পাক খেয়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় গতি এবং প্রত্যেকের গঠন অধ্যয়ন করে জ্যোতির্বিদরা নির্ণয় করতে পারেন, এই গতিময়তা বজায় রাখার জন্য কতটা মহাকর্ষ বলের প্রয়োজন। একই সাথে অনুমান করতে পারেন, কতটা অদৃশ্য তথা গুপ্ত পদার্থ থাকলে এই মহাকর্ষ বলের উদ্ভব হতে পারে।
মহাবিশ্বে কি পরিমাণ গুপ্ত পদার্থ রয়েছে? মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতি একটি মাত্র অজানা রাশির উপর নির্ভর করছে। সেটি হল মহাবিশ্বের মোট ভর। মহাবিশ্বের ঘনত্ব যদি বেশী হয় তাহলে মহাকর্ষ ক্রিয়ার প্রভাবে এক সময় এর প্রসারণ বন্ধ হয়ে যাবে এবং এটি সংকুচিত হতে শুরু করবে যাকে মহা সংকোচন বলে। মহাবিশ্বের এই অবস্থাকে বলে “বদ্ধ মহাবিশ্ব”। সংকোচনের পর আবার প্রসারণ শুরু হতে পারে। কিন্তু মহাবিশ্বের ঘনত্ব যদি কম হয়, তাহলে এটি আজীবন প্রসারিত হতে থাকবে। এ ধরণের মহাবিশ্বকে বলে “উন্মুক্ত মহাবিশ্ব”।
এ পর্যন্ত যতদূর পর্যবেক্ষণ করা গেছে তা উন্মুক্ত মহাবিশ্বকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ এটি আজীবন প্রসারিত হতে থাকবে। সকল দৃশ্যমান পদার্থ এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অনুমানকৃত গুপ্ত পদার্থের পরিমাণ একসাথে যোগ করলে মোট যে ভর পাওয়া যায় তা মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ করার জন্য নেহাতই কম। প্রসারণ বন্ধ করতে হলে যে ঘনত্বের প্রয়োজন এই ঘনত্বের মান তার শতকরা মাত্র ২০ ভাগ।
আমি এখানে সংকোচন-প্রসারণের গল্প শেষ করে দিতে পারতাম যদি না বিশ্বতত্ত্ববিদরা উন্মুক্ত এবং বদ্ধ ছাড়া মহাবিশ্বের আরও এক ধরণের মডেল উত্থাপন করতেন। এই মডেল মোতাবেক মহাবিশ্বের একটি ক্রান্তি ঘনত্ব রয়েছে যা উচ্চ এবং নিম্নের মাঝামাঝি। এটি ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের ধারণা দেয় যার ঘনত্ব একেবারে সঠিক। বর্তমানে মোট পদার্থের যে পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে তা প্রসারণ বন্ধ করার উপযোগী নয়। তারপরও নতুন এই মডেল প্রস্তার করে, কোন একদিন এমন কিছু অজানা শক্তি বা পদার্থের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে যারা প্রসারণ বন্ধে সক্ষম। একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি মানতে বাধ্য যে, একসময় এই বিশাল শক্তির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তাই বলে, এই পরিস্থিতিতে আমি এমন কোন মহাজাগতিক মডেলকে মেনে নিতে পারি না যার জন্য প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ এখনও করা সম্ভব হয় নি।
আরেকটি জটিলতা রয়েছে যা এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। সেটা হচ্ছে সম্পূর্ণ গুপ্ত কোন ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকতে পারে- এমন ব্যবস্থা যেখানে কেবলই গুপ্ত পদার্থ থাকবে। দৃশ্যমান পদার্থের সাধ্য নেই সেই ব্যবস্থাকে ভেদ করার। বর্তমানে আমরা জানি না আদৌ কোন অদৃশ্য পদার্থ ব্যবস্থার অস্তিত্ব আছে কি-না। পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এর সম্ভাবনা উড়িয়েও দেয়া যায় না, আবার মেনেও নেয়া যায় না।
কি এই গুপ্ত পদার্থ?
গুপ্ত পদার্থ যেমনই হোক না কেন, একটা বিষয় নিশ্চিত যে মহাবিশ্বে এই পদার্থ বিপুল পরিমাণে রয়েছে। প্রতি গ্রাম দৃশ্যমান পদার্থের বিপরীতে হয়তো দশ গ্রাম বা তার চেয়েও বেশী গুপ্ত পদার্থ আছে। জ্যোতির্বৈজ্ঞানের বিচারে এখনও বোঝা যায় নি, কি দিয়ে এই পদার্থ গঠিত। কেউ এমনও বলতে পারেন, আমরা গুপ্ত পদার্থ পর্যবেক্ষণের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। গুপ্ত পদার্থের গাঠনিক উপাদানের দাবী করতে পারে এমন বেশ কিছু অদৃশ্য ভর রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু একেবারে সাধারণ, কিছু কিছু আবার বেশ উদ্ভট।
আরেকটি বিষয় হল, বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করার কোন অবকাশ এখানে নেই। পদার্থের উৎপত্তির প্রচলিত কাঠামোতেই আমাদের কাজ করতে হবে। মহা বিস্ফোরণের পর মৌলিক পদার্থের উৎপত্তি বিষয়ে কেন্দ্রিন সংশ্লেষ (Nucleosynthesis) নামে যে প্রক্রিয়া রয়েছে তাই হতে পারে কাঠামো। মহাবিশ্বে সাধারণ পদার্থের কি পরিমাণ বেরিয়ন-কণা থাকতে পারে তার একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয় এই প্রক্রিয়া। আদি মহাবিশ্বের প্রমিত মডেল থেকে এই সীমার মান পাওয়া যায়। এই মডেলের একটি উন্মুক্ত রাশি আছে- বেরিয়ন এবং ফোটনের পরিমাণের অনুপাত।
মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের তাপমাত্রা থেকে ফোটনের মোট সংখ্যা জানা গেছে। এখন, বেরিয়নের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই তারা এবং ছায়াপথগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। হালকা কেন্দ্রিনের (Nuclei) মহাজাগতিক প্রাচুর্য বিষয়ে জানার জন্যই এই পর্যবেক্ষণ। কারণ হালকা কেন্দ্রিন একমাত্র উপাদান যা মহা বিস্ফোরণের পরপরই গঠিত হয়েছিল।
কেন্দ্রিন সংশ্লেষের সীমা অতিক্রম না করেই আমরা একটি স্বল্প ঘনত্ববিশিষ্ট উন্মুক্ত মহাবিশ্বের গ্রহণযোগ্য মডেল তৈরী করতে পারি। এই মডেলে আমরা বেরিয়ন এবং অদ্ভুত পদার্থের (নন-বেরিয়নিক কণা) পরিমাণ প্রায় সমান হিসেবে ধরতে পারি। কিন্তু এগুলো মিলিয়েও বদ্ধ মহাবিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় ভরের শতকরা মাত্র ২০ ভাগের সন্ধান পাওয়া যায়। মহাবিশ্বের এই মডেল আমাদের প্রকৃত সবগুলো পর্যবেক্ষণের সাথেই মিলে যায়। অপরদিকে এই মডেলে সামান্য পরিবর্তন এনে যদি উন্মুক্ত মহাবিশ্বের মডেল করে দেয়া হয় তাহলেও তা পর্যবেক্ষণগুলোর পক্ষেই যায়। উন্মুক্ত মডেলের ক্ষেত্রে সকল পদার্থই বেরিয়নিক। দুর্ভাগ্যবশত, উন্মুক্ত মহাবিশ্বের এই বিকল্প মডেলে বেরিয়নের পরিমাণ এতো বেশী যে তা কেন্দ্রিন সংশ্লেষের সীমাকে অতিক্রম করে। সেহেতু, নিম্ন ঘনত্ববিশিষ্ট বদ্ধ মহাবিশ্বের মডেলে বেশ রহস্যজনক কিছু ধর্ম রয়েছে: মহাবিশ্বের অধিকাংশ বেরিয়নই অদৃশ্য থাকবে এবং তাদের প্রকৃতি সম্বন্ধে জানা যাবে না। আর অধিকাংশ মডেলেই মহাবিশ্বের পদার্থগুলো প্রকৃতি অদ্ভূত এবং অজানা।
অদ্ভুত কণা
তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীরা গুপ্ত পদার্থের গাঠনিক উপাদান হিসেবে অনেকগুলো বস্তুকেই নির্দেশ করেছেন। অবশ্য এই বিচিত্র বস্তুর মধ্যে অনেকগুলোই পর্যবেক্ষণের অতীত। বেরিয়নিক গুপ্ত পদার্থের গাঠনিক উপাদান হিসেবে ডে সমস্ত বস্তুর উদাহরণ টানা হয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে: কৃষ্ণ বিবর (বড় এবং ছোট), ধূসর বামন (এতোটা শীতল ও মৃয়মান তারা যারা যথেষ্ট আলো বিকিরণ করতে পারে না), সূর্যের সমান আকৃতির ম্যাচো (MACHO), শীতল গ্যাস, গুপ্ত ছায়াপথ এবং গুপ্ত স্তবক।
এতো গেল বেরিয়নিক গুপ্ত পদার্থের কথা। নন-বেরিয়নিক গুপ্ত পদার্থের গাঠনিক উপাদানগুলো এখনও তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কল্পনার জগতেই রয়ে গেছে। এ ধরণের অনেকগুলো কণার মধ্যে কয়েকটি হল: ফোটিনো, নিউট্রিনো, গ্র্যাভিটন, অ্যাক্সিয়ন এবং চৌম্বক একমেরু। এগুলোর মধ্যে সনাক্তকারীরা কেবল নিউট্রিনো চিহ্নিত করতে পেরেছেন। নিউট্রিনোর আদৌ কোন ভর আছে কি-না সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নন। অন্যান্য অদ্ভূত কণা চিহ্নিত করার জন্য সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া চলছে। আসলেই যদি তাদের অস্তিত্ব থাকে এবং তাদের ভর যদি আশানুরূপ সীমার মধ্যে পড়ে তাহলে সেগুলোই হতে পারে গুপ্ত পদার্থের গাঠনিক উপাদান। অবশ্য আশাগুলো একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে।
ব্যাপক অর্থে চিন্তা করলে, ছায়াপথ এবং স্তবকের বিবর্তন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার জন্য আগে গুপ্ত পদার্থের ধর্ম সম্বন্ধে জানতে হবে। এই ধর্মগুলো না জানলে, ছায়অপথগুলো বিবর্তিত হয়ে কিভাবে বর্তমান অবস্থায় এসেছে তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব না।আদি মহাবিশ্ব বিষয়ে আমাদের জ্ঞান যেহেতু প্রতিনিয়তই বাগছে, সেহেতু আশা করা যায় অচিরেই ছায়াপথের গঠন এবং গুপ্ত পদার্থ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত জানতে পারব।
আমাদের চোখ বা সনাক্তকারী যন্ত্রের মাধ্যমে যা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সহায়তায় সে সম্বন্ধে উপলব্ধি করা সম্ভব। গুপ্ত পদার্থ সন্ধানের ক্ষেত্রে বর্তমানে কম্পিউটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এতোদিন মূলত পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করতেন। বর্তমানে পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানের উপর সেই গুরুত্বটি দেয়া হচ্ছে। বর্তমানের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণগুলো গবেষণাগারের টেবিল বা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের লেন্সে কাজ করে না, কাজ করে কম্পিউটার টার্মিনালে। বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারের মাধ্যমে মহাজাগতিক সিম্যুলেশন তৈরী করেন। এই সিম্যুলেশনে হাজার হাজার বিন্দুর মাধ্যমে তারা, গ্যাস এবং গুপ্ত পদার্থকে নির্দেশ করা হয়। তারপর একটি ছায়াপথের সমগ্র জীবনের ব্যাপ্তীতে এই বিন্দুগুলোর মিথস্ক্রিয়া ঘটানো হয়। বিশ্বত্ত্ববিদরা সিম্যুলেশনে গুপ্ত পদার্থের পরিমাণ পরিবর্তন করে দেখতে পারেন, বিচ্ছিন্ন ভার্চুয়াল ছায়াপথের উপর তার কি প্রভাব পড়ে। বিচ্ছিন্ন ছায়াপথের বদলে সিম্যুলেশনের মাধ্যশে অনেক ছায়াপথের ভীড়ও তৈরী করা যায়।
এ হিসেবে কম্পিউটার মডেল ছায়াপথের ব্যবহার সম্বন্ধে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দুইটি ছায়াপথ যখন খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করে তখন দুই ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে। এক হয়তো তারা তীব্র সংঘর্ষের মাধ্যমে একে অপরের উপর ধ্বসে পড়তে পারে অথবা সামান্য স্পর্শ করে চলে যেতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই মাঝেমাঝে জোয়ার-ভাটাজনিত দীর্ঘ লেজের সৃষ্টি হয়। বর্তমান মডেলগুলোর মাধ্যমে জানা গেছে, ছায়াপথের বর্ণবলয়ে দৃশ্যমান পদার্থের তুলনায় গুপ্ত পদার্থের পরিমাণ ৩ থেকে ১০ গুণ বেশী হলেই কেবল এ ধরণের লেজ তৈরী হওয়া সম্ভব। বর্ণবলয় যত ভারী হয় লেজ ততই খাটো এবং মোটা হয়। কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে এই তথ্য পাওয়া গেছে এবং এটি বেশ কিছু ক্ষেত্রে জ্যোতির্বেজ্ঞানীদেরকে সহায়তা করেছে। এর মাধ্যমে ছায়াপথকে এরকম দেখা যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করা যায় এবং যে গুপ্ত পদার্থ দেখা যায় না সে সম্বন্ধেও এ থেকে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারেন তারা। বিশ্বতত্ত্বের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত কম্পিউটার সিম্যুলেশন পর্যবেক্ষণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
চিন্তা করার নিত্য নতুন পদ্ধতির পাশাপাশি নতুন নতুন যন্ত্র ও প্রযুক্তিগুলো স্বর্গ সম্বন্ধে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি বাড়িয়ে চলেছে। আজ থেকে মাত্র ৪০০ বছর আগে গ্যালিলিও একটি কার্ডবোর্ড টিউবের এক পাশে রেখেছিলেন একটি লেন্স, আর অন্য পাশে একটি বড় মস্তিষ্ক স্থাপন করে রহস্যময় স্বর্গের ভুবনে বিচরণ করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আকাশজুড়ে আকাশগঙ্গা নামে পরিচিত যে মৃয়মান আলোর ডোরা দেখা যায় তা আসলে কোটি কোটি একক তারা ও তারা স্তবক দিয়ে গঠিত। তৎক্ষণাৎ, মানুষ বুঝতে পারলো ছায়াপথ কাকে বলে। এম তো হতেই পারে যে, আগামী শতাব্দীতে আরেকটি বৃহৎ মস্তিষ্ক (যার এখনও জন্ম হয়নি), লেন্সের চেয়ে অনেকগুণ চটপটে ও কর্মক্ষম যন্ত্রের এক পাশে তার চোখ স্থাপন করবে এবং অবশ্যই গুপ্ত পদার্থ কি, এই প্রশ্নের উত্তর বের করে নিয়ে আসবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন