বেকারত্বের দাসত্ব থেকে আমরা মুক্তি চাই। বেকারত্বের শিকলে বন্দী এই দেশ, ফলে কেউ ঘুরছে টেন্ডার বড় ভাইদের পিছনে, কেউ হায় হায় কোম্পানীর (এমএলএম) ফাইল নিয়ে, আবার কেউ মামার খোজে দৌড়াচ্ছে। পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ জনবহুল এই দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশের মানুষ হিসেবে আমরা কতটুকু সুখী। হ্যা, সুজলা সুফলা বাংলাদেশ নদী মাতৃক ধানশালিকের এই সবুজ ভূখন্ডে পুকুর ঘাটে আর দক্ষিণের বারান্দায় বসে দক্ষিণা বাতাস আমাদের হৃদয় মনে যে দোলা দিয়ে যায় তাতে জসিম উদ্দিন বা জীবনানন্দ দাসের মতো অমর সৃষ্টি সম্ভব না হলেও কিছুটা চেষ্টার প্রয়াস আমরা খুজে পাই। গোয়াল ভরা গরু আর গোলা ভরা ধান কিংবা পুকুর ভরা মাছ এগুলো এখন মা, নানু দাদুদের কাছ থেকে শুনে রূপকথার মতোই মনে হয়। বারান্দায় বসে কিংবা বাড়ীর উঠোনে বা ছাদে বসে দক্ষিণা বাতাসে কিছুটা জিরিয়ে নেয়ার ফুসরত এখন আমাদের আর নেই। একসময় সন্ধ্যার পর বিদ্যুত চলে গেলে হারিকেন, চেরাগ বা মোমবাতি খুজাখুজি শুরু হতো। আর এখন ঘরে ঘরে চায়না চার্জারের আলোতে অনেক ফকফকা। একসময় রাতে বিদ্যুত চলে গেলে বিল্ডিংয়ের সমবয়সী ছেলে মেয়ে আর মা খালারা জড়ো হতাম ছাদে আর এখন পাশের বাসায় কে থাকে তার সাথে এক কাপ চাও খাওয়া হয় না। আসলে আমরা কি গতিশীল? নাকি গতিহীন গতর জ্বালায় আমাদের স্বত্ত্বা পূড়ে গেছে, ম্রিয়মান হয়ে গেছে। আসলে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি আমাদের দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে মনের আবেগ।
শুরুতেই বলেছিলাম বেকারত্বের কথা। হ্যা সদ্য মাস্টার্স পাস করা বন্ধুদের চাকুরী নামক সোনার হরিণের পিছনে দৌড় ঝাপ দেখে এবং নিজেরও তুলনামুলক আরো ভালো কিছু করার সুযোগ খুজতে গিয়ে আবেগের কিছু কথা লিখতে ইচ্ছে হলো। এসমাজে আমরা একটি সংখ্যাগরিষ্ট অংশই রয়ে গেছি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। ফলে লেখা পড়ার গন্ডির শেষ দিকে এসে আমরা চাকুরীর জন্য পাগলপ্রায় হয়ে দৌড়াতে থাকি এদিক ওদিক। আর এখানে যাদের পরিবারের আর্থিক ও মামুর জোর সাপোর্ট দেয় তারাই ভালো অবস্থানে দ্রুত পৌছুতে পারে।
গ্রামে কাজ নেই। শ্রমবাজারে বিপর্যয়, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে হাজার হাজার শ্রমিক প্রতিদিন চোখ মুছতে মুছতে বিমানবন্দরে এসে নামছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ধীরগতির তাই গ্রামের সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ কাজ পাচ্ছে না। প্রতিবছর ১৫লাখ নতুন মুখ এসে যুগ হচ্ছে শ্রমবাজারে। গায়ে খাটা এসব মানুষ তবুও বেকার থাকছে। ছাটাইয়ের শিকার হচ্ছে শিল্প কারখানা থেকে।
২০০৭-০৮ অর্থ বছর শেষে দেশে মোট শ্রমশক্তি ছিল ৫কোটি ১৮লাখ। কর্মসংস্থান ছিল ৪কোটি ৯৭লাখ ৪০হাজার। বেকার ছিলেন ২০লাখ ৬হাজার। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে মোট শ্রমশক্তি ৫কোটি ৩০লাখ। এর মধ্যে ৫কোটি ১০লাখের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা থাকলেও সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ আর হচ্ছে না। ২০০৮এর অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২১লাখ। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৪কোটি ৯৫লাখ। কাজ আছে এমন মানুষের সংখ্যা হজেচ্ছ ৪কোটি ৭৪লাখ। যা মোট শ্রমশক্তির ৪.২শতাংশ।
আইএলও প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় বেকারত্বের হার ১৬ভাগ। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১৫বছরের উর্দ্ধ বয়সী যুব জনসংখ্যা ৮কোটি ৮লাখ ৪৩হাজার। এদের মধ্যে ৪কোটি ৪০লাখ ২২হাজার তরুণ কমবেশি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। তবে এদের অনেকেরই আয় দৈনিক ৬০/৭০টাকার কম। এদের পুরোপুরি বেকার বলা না গেলেও একেবারে নিরেট বেকার ৩কোটি ৬০লাখ। আইএলও ২০০৬এর রিপোর্ট অনুযায়ী বেকারত্বের হারের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে ১২তম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি অ্যানালাইসিস ইউনিটের ২০০৮সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, উচ্চ মাধ্যমিক থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার তুলনামুলকভাবে বেশি। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো শিক্ষিতরা যেনতেন কাজ করতে আগ্রহী নন। এছাড়া শিক্ষিতের মধ্যে আংশিক বেকারত্বের হার অনেক বেশি। যারা সপ্তাহে ৩৫ঘন্টারও কম সময় কাজ করেন, তাদেরই সাধারণ আংশিক বেকার বিবেচনা করা হয়।
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সেপ্টেম্বর’১০ সংখ্যায় প্রকাশিত, দিন দিন বেড়েই চলছে বেকারত্বের হার। বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২কোটি ৪৪লাখ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১৩.৪শতাংশ। ১৯৯০সালের তুলনায় এসংখ্যা প্রায় ১১শতাংশ বেশি। ২০০২সালে বেকারত্বের হার ছিল ৮ শতাংশ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) ২০০৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বেকারত্বের হার ভারত ও ভিয়েতনামের চেয়ে বেশি। ভারতে বেকারত্বের হার ১১শতাংশ, আর ভিয়েতনামে ৫শতাংশ।
আবেদন করতে করতে প্রার্থীদের পকেট ফাঁকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে আবেদনের টাকা জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বেকার যুবক প্রার্থীকে। ওদিকে দরখাস্তের স্তুপ থেকে সুখবর আসবে কি? এই টেনশনে জীবনটা যেন প্রাণহীন হয়ে পড়ছে তার। ওদিকে পরিবারের চাহিদা, নিজের ভবিষ্যতের সব মিলিয়ে স্থবির হয়ে আছে যুবক। বেকারের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিদিন। শুধু বিডি জবস অনলাইনে প্রতিদিন গড়ে ২৫হাজার হিট করছেন প্রার্থীরা।
পরিকল্পনা কমিশন ও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউএনডিপির এক গবেষণা অনুযায়ী ২০১৫সালের মধ্যেই দেশে কর্মক্ষম যুব সংখ্যঅ দাড়াবে তিন কোটি। বেকারত্বের হার বর্তমানের পর্যায়ে রাখতে হলে এ সময়ের মধ্যে এক কোটি ১০/লাখেরও বেশি যুবককে চাকরী দিতে হবে। আইএলও হিসাব অনুযায়ী ২০১৫সালের মধ্যেই বাংলাদশে বেকারের সংখ্যা দাড়াবে ৬কোটি। প্রতিবছর ২৭লাখ লোক বিশ্ব শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও কাজ পাবেন মাত্র ৭লাখ।
অভিজ্ঞতা থাকলে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলযোগ্য শর্ত আরোপ করায় অভিজ্ঞদের কাছে হার মানতে হচ্ছে শিক্ষিত সার্টিফিকেট ধারীদের। তারপর কোটাপ্রথা, রাজনৈতিক লবিং, মামার জোড় সব মিলিয়ে বেকার কর্মহীন যাদের বলার কেউ নেই, করার কেউ নেই তাদের অবস্থা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো। ফলে একটা সময় হতাশায় জর্জরিত যুবক জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে। তাহলে কি বলতেই হয় এ দেশ এ মাটি আমাদের বসবাসের নিরাপদ ঠিকানা এখনও নয়। তাহলে রুপকল্প ২০২১কতটুকু সফলতা আনতে পারবে। বিদেশী বিনিয়োগ কমে গেছে, রপ্তানীও কমেছে, প্রবাস থেকে কর্মহীন শ্রমিকরা বেকার হয়ে দেশে ফিরছে। সর্বস্ব বিক্রি করে প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকদের মিছিলও আজ বেশ বড়। আর এদিকে শিক্ষিত বেকারদের নিয়ে মা বাবারা পড়েছেন বেকায়দায়। কেননা শিক্ষিত বেকাররা যেন তেন চাকরি করতে নারাজ। সুযোগ বুঝে দেশে প্রবেশ করছে হায় হায় কোম্পানী, ডান হাতে দুই, বাম হাতে দুই এভাবে নেটওয়ার্ক বড় করতেই তাদের তৎপরতা। একসময় একটি বড় পুজি সংগ্রহ করে মাঠের কর্মীদের তৎপর রেখেই তারা সটকে যাচ্ছে। ফলে মাঠে থাকা কর্মীরা যারা অন্যদের অল্প বিনিয়োগে লাভের স্বপ্ন দেখিয়ে মেম্বারশীপ দিয়েছিল তারাও আটকে গেছে প্রতারনার ফাঁদে। নিজের পুজি তো গেছেই সাথে সাথে বন্ধু ও নিকটজনদের সদস্য করে তারা এখন সমাজে প্রতারক পরিচয় বহন করছে।
রাজনৈতিক একটি মিছিলে কর্মীদের অংশগ্রহণ করাতে নেতাদের অনেক হিমশিম খেতে হয়, ছোটনেতাদের বাজেট দিতে হয় প্রতিকর্মীর মাথা পিছু খরচের জন্য। কিন্তু শিক্ষিত কর্মহীন যুবকরা যে মিছিলে অংশগ্রহণ করছি তাতে কেউ পয়সা দেয়না আর সে মিছিলটি বেকারদের মিছিল। যদিও আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ফুসরাত কারো নেই তবুও নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বাতাসের ইথারে একটি শব্দ ছেড়ে দেই, আর কত দীর্ঘ হবে বেকারত্বের মিছিল? কবে পাবো একটি নিরাপদ চাকুরির নিশ্চয়তা! আমি বেকার থাকতে চাই না!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন